কালকে কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন বলে তাই এনার নাম কালিকা। সৃষ্টি ও ধ্বংস এই দুই মহাশক্তি একত্রিত হয়েছে এই দক্ষিণাকালীর রূপে। অগ্নির ধুম্রপুঞ্জ মহামেঘ ও সূর্য হীন অন্ধকার মিলে দেবী দক্ষিণা কালীর গাত্রবর্ণ। কালিকা হতেই
সকল দেবতার তথা জীব কুলের সৃষ্টি আবার এই রূপেই তিনি সকল ব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংস কর্ত্রী। যার চরণে ত্রিদেব সেবা তথা স্তুতি করেন তিনিই দক্ষিণাকালী।
মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে–
কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্তিতঃ।
মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পরা।।
কালসংগ্রহণাৎ কালী সর্বেষামাদিরূপিণী।
কালত্বাদাদিভূতত্বাদাদ্যা কালীতি গীয়সে।। –
অর্থাৎ– তিনি মহাকাল, তিনি সর্বপ্রাণীকে কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন বলিয়াই মহাকাল; দেবী আবার এই মহাকালকে কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন, এই নিমিত্ত তিনি আদ্যা পরম ‘কালিকা’। কালকে গ্রাস করেন বলিয়াই দেবী কালী। তিনি সকলের আদি, সকলের কালস্বরূপা এবং আদিভূতা, এই নিমিত্তই লোকে দেবীকে আদ্যাকালী বলিয়া কীর্তন করে।
বিভিন্ন পুরাণ-তন্ত্রাদির মধ্যে ‘কালীতন্ত্র’-ধৃত কালীর বর্ণনাই কালীর ধ্যানরূপে কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসারে গৃহীত হয়েছে। তন্ত্রসারে বর্ণিত কালীর এ রূপই এখন সাধারণভাবে বাঙলা অঞ্চলের মাতৃপূজায় গৃহীত। তন্ত্রসারের বর্ণনা অনুযায়ী দেবী কালীর রূপ হলো–
করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম্।
কালিকাং দক্ষিণা দিব্যাং মুখমালাবিভূষিতাম্।।
সদ্যচ্ছিয়শিরা খড়গবামাধোকরাম্বুজা
অভয়ং বরদবৈ দক্ষিণোৰ্ব্বাধঃপাণিকাম্।।
মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চৈব দিগম্বরীম্।
কণ্ঠাবসক্তমুণ্ডালীগলরদিনচর্চ্চিতাম্।।
কর্ণাবতংসতানীত-শবযুগ্মভয়ানকাম্। ঘোরদংষ্ট্রাং করালাস্যাং পীনোন্নত পয়োধরাম্।।
শাবানাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসম্মুখীম।
সুরাগলক্তধারাবিস্ফুরিতাননাম্।।
ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং শ্মশানালয়বাসিনীম্।
বালার্কমণ্ডলাকার-লোচনত্রিতয়ান্বিতাম্।।
দারাং দক্ষিণব্যাপি মুক্তালম্বিকচোচ্চয়াম্ ।
শবরূপমহাদেব-হৃদয়োপরি সংস্থিতাম্। শিবাত্তিঘোররাবাভিশ্চতুদ্দিক্ষু সমন্বিতাম্।।
মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্।
সুখপ্রসন্নবদনাং স্মেরাননসরোরুহাম্।।
এবং সঞ্চিন্তয়েৎ কালীং ধর্মকামার্থসিদ্ধিদাম্ ।।
অর্থাৎ-
দেবী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, দক্ষিণা, দিব্যা, মুণ্ডমালাবিভূষিতা। বামহস্ত-যুগলের অধোহস্তে সদ্যশ্ছিন্ন শির, আর ঊর্ধ্বহস্তে খড়্গ; দক্ষিণের অধোহস্তে অভয়, ঊর্ধ্বহস্তে বর। দেবী মহামেঘের বর্ণের ন্যায় শ্যামবর্ণা (এইজন্যই কালী-দেবী শ্যামা নামে খ্যাতা) এবং দিগম্বরী; তাঁহার কণ্ঠলগ্ন মুণ্ডমালা হইতে ক্ষরিত রুধিরের দ্বারা দেবীর দেহ চর্চিত; আর দুইটি শবশিশু তাঁহার কর্ণভূষণ। তিনি ঘোরদ্রংষ্ট্রা, করালাস্যা, পীনোন্নতপয়োধরা; শবসমূহের করদ্বারা নির্মিত কাঞ্চী পরিহিতা হইয়া দেবী হসন্মুখী। ওষ্ঠের প্রান্তদ্বয় হইতে গলিত রক্তধারা-দ্বারা দেবী বিস্ফুরিতাননা; তিনি ঘোরনাদিনী, মহারৌদ্রী– শ্মশানগৃহবাসিনী। বালসূর্যমণ্ডলের ন্যায় দেবীর ত্রিনেত্র; তিনি উন্নতদন্তা, তাঁহার কেশদাম দক্ষিণব্যাপী ও আলুলায়িত। তিনি শবরূপ মহাদেবের হৃদয়োপরি সংস্থিতা; তিনি চতুর্দিকে ঘোররবকারী শিবাকুলের দ্বারা সমন্বিতা। তিনি মহাকালের সহিত ‘বিপরীতরতাতুরা’, সুখপ্রসন্নবদনা এবং ‘স্মেরাননসরোরুহা’।
কৃষ্ণানন্দের আগে বাংলায় কালীপুজো হত ঘটে, যন্ত্রে কিংবা শিলাখণ্ডে। মূর্তিতে কালীপুজোর প্রচলন তখনও হয়নি। বাড়িতে নয়, পুজো হত শ্মশানে, রাস্তার তেমাথায়, নদীতীরে বা গভীর অরণ্যে। ‘কণ্ঠাবসক্ত-মুণ্ডালীগলদ্রুধিরচর্চ্চিতাম্। কর্ণাবতংসতানীতশবযুগ্মভয়ানকাম্। …মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্।’ ধ্যানমন্ত্র অনুসারে যাঁর গলায় শোভা পায় মুণ্ডমালা, দুই কানে দু’টি শব, যিনি মহাকালের সঙ্গে বিপরীত রতাতুরা, কৃষ্ণানন্দের প্রভাবে সেই শ্মশানবাসিনী কালী হয়ে উঠলেন বাঙালির আদরিণী শ্যামা। যে কালীপুজো এক সময়ে গৃহে ছিল নিষিদ্ধ, কৃষ্ণানন্দের হাত ধরেই সেই দেবী প্রবেশ করলেন বাংলার ঘরে ঘরে।শ্মশানবাসিনী ক্রমে ঠাঁই নিলেন বাঙালির ঘরে।তার আগে কালীপুজো হত ঘটে, যন্ত্রে কিংবা শিলাখণ্ডে। শ্মশান, নদীতীর বা গভীর অরণ্যের নির্জনতাই ছিল কালীপূজার স্থান। শ্মশানবাসিনী ক্রমে ঠাঁই নিলেন বাঙালির ঘরে।